December 23, 2024, 1:39 am
জাহিদুজ্জামান/
কুষ্টিয়ার লাহিনী-সান্দিয়ারা বেহাল সড়কে এলজিইডির মেরামতের উদ্যোগ কোন কাজেই আসছে না। মাটি, বালু এবং খোয়া দিয়ে গর্ত বন্ধের চেষ্টা বৃথা হচ্ছে। ধুলোয় মিশে যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই। সড়কে চলাচলকারী এবং স্থানীয়রা এই সংস্কার কাজকে “নাম মাত্র” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর চাপড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বলেছেন, এতে “টাকা নষ্ট” হচ্ছে। এলজিইডি কর্তৃপক্ষ বলছে, ভ্রাম্যমাণ রক্ষণাবেক্ষণ ফান্ড থেকে বড় বড় গর্তগুলো এভাবে মেরামত করা ছাড়া কিছুই করার নেই তাদের। আগের ঠিকাদার কাজ না করায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
কুষ্টিয়ার শহরতলীর লাহিনী থেকে কুমারখালী উপজেলার সান্দিয়ারা পর্যন্ত প্রায় ১৯ কিলোমিটার সড়ক গত তিন বছর ধরে একেবারে বেহাল, চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সড়কটি সান্দিয়ারা পেরিয়ে মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর উপজেলার লাঙ্গলবন্ধ পর্যন্ত গেছে। এই সড়কটি বিপুল জনগোষ্ঠীর যোগাযোগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার যদুবয়রা, চাপড়া, চাঁদপুর, পান্টি ও বাগুলাট ইউনিয়ন, খোকসা উপজেলার ওসমানপুর ইউনিয়ন, ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার কিছু অংশ এবং মাগুরার মোহাম্মদপুর উপজেলা মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ মানুষ এই সড়কের ওপর নির্ভরশীল। এদের জন্য সড়কটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন এটি ভাল ছিলো খুবই ব্যস্ত থাকতো। এখনো প্রয়োজনে ভোগান্তি মেনে নিয়েই এই সড়কে চলতে হচ্ছে তাদের। সড়কের এর উপরিভাগের পিচ-পাথর-ইটের আবরণ ধুলোয় মিশে গেছে। পুরো সড়ক জুড়েই মনে হচ্ছে ইট আর বালুর মিশ্রণের ধুলো বিছিয়ে রাখা হয়েছে। কমপক্ষে ৬ইঞ্চি পুরুর এই ধুলোর আবরণের নিচে অসংখ্য গর্ত। প্রতিদিনই দুর্ঘটনায় পড়ছে অটো রিক্সাসহ ছোট ছোট যানবাহন। মানুষ আহত হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে মালামাল। সব যানবাহনের চালককে ঝুঁকি নিয়ে একেবারে ধীরে চলতে হচ্ছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সড়কটি এখনো চাষ দেয়া জমির মতো। কুষ্টিয়ার লাহিনী প্রান্ত থেকে কিছুদূর এগুলেই আর সড়কের পিচ চোখে পড়ে না। জায়গায় জায়গায় বড় বড় গর্ত। ইটের রঙের মতো লালচে ধুলো ছড়িয়ে আছে সড়ক জুড়ে। যানবাহন গেলেই ধুলো উড়ে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের প্রধান খালের উত্তর পাড়ের ওপর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সড়কটি। খাল দিয়ে বয়ে যাচ্ছে টলমলে পানি। চারিপাশে সবুজ ফসলের ক্ষেত। খালের পাড় জুড়ে বড় বড় বৃক্ষরাজি। সব মিলিয়ে এক অনিন্দ সুন্দর পরিবেশ। কিন্তু সড়কের ধুলো উড়ে নষ্ট করে দিচ্ছে সব। সবুজ পরিবেশ ধূষর করে ফেলছে, করছে দূষিত। অটোরিক্সা চালক মো. রাকিব বলেন, এই রোডে আমাদের খুবই সমস্যা, যাত্রী নিয়ে যখন যাই উল্টে পড়ে। যাত্রীর হাত-পা ভাঙে, অটো ক্যানালে পড়ে যায়। ভেঙ্গে যায়, খরচ বাড়ে। রাকিব বলেন, গর্ভবর্তীদের যাত্রী হিসেবে নেয়াই যায়না। যেভাবে সংস্কার করেছে তা নামমাত্র। কী করেছে, যেখানে গর্ত ছিলো ইট ফেলে দিয়ে চলে গেছে। এভাবে কী টেকে? অটোরিক্সা চালক খবির উদ্দিন বলেন, রাস্তা যে উচু নিচু, আকা বাকা হয়ে গেছে এগুলো কিছু ঠিক করছে না। ১০টা গর্ত থাকলে ৭টায় ইট-বালু ফেলছে বাকী ৩টা ওইভাবেই রেখে দিচ্ছে। রাস্তা যদি কোনমতে সমান করে দিতো তাহলেও আমরা চলতে পারতাম। এই আলগা ইট কী টেকে, চাকার সাথে আবার গুড়ো গুড়ো হয়ে যাচ্ছে বলেন তিনি। স্থানীয় বাসিন্দা মো. সাত্তার বলেন, এক সম্পাহ আগে ইট-বালু ফেলতে দেখা গেছে। কিছুটা সমান হয়েছিল। আবার যা তাই হয়ে গেছে। তিনি বলেন, সড়কটি চলাচলের অনুপযোগী। প্রতিদিনই কোন না কোন গাড়ী ভেঙ্গে যাচ্ছে। অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে, অটো উল্টে যাচ্ছে। যাত্রীদের হাত-পা ভেঙ্গে যাচ্ছে।
এই সড়কে সান্দিয়ারার দিকে এগুতে থাকলে রাস্তার পিচ আর দেখা যায় না। ঢেকে আছে ধুলোয়। রাস্তার সব উপকরণ যানবাহনের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে রঙিন ধুলোয় পরিণত হয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর নির্মাণ সামগ্রীবাহী বড় বড় ট্রাক যাচ্ছে আর ধুলো উড়ে পুরো এলাকা ছেয়ে যাচ্ছে। সীমিত হয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিসীমা। স্থানীয় বহলা গ্রামের সাজ্জাদ হোসেন বলেন, তিন বছর ধরে ভাঙা রাস্তার কারণে আমরা গাড়ীতে উঠতে পারছি না। মাঝে মাঝে অটোরিক্সা মানুষসহ উল্টে পড়ছে। আমরা গিয়ে ধরে তুলি। রাস্তা খুবই খারাপ, ঠিক করা দরকার। সাজ্জাদ বলেন, একটানা ৪কিলোমিটার রাস্তা ভাঙ্গা। তারপর কিছুটা ভাল। আবার ভাঙ্গা। অটোরিক্সা চালক রবিউল ইসলাম বলেন, রাস্তার কারণে মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ঝালাই খরচ হচ্ছে। ঝাকিতে যেদিন গাড়ী ভেঙ্গে যাচ্ছে, সেদিন ইনকামও হচ্ছে না আবার টাকা খরচ করে সারতে হচ্ছে। তিনি বলেন, রাস্তাটা নতুন করে করা দরকার। মোটরসাইকেল আরোহী আফরিন সাগরের সঙ্গে কথা হয়। তার বাড়ি লাহিনী। তিনি বলেন, প্রচুর ধুলা, ইটের গুড়া উড়ছে। রাস্তা একেবারে ভাঙ্গা। সব মিলিয়ে জীবন দুর্বিসহ। মাস্ক ছাড়া এই রাস্তায় যাওয়াই যায় না। মাঝে মধ্যেই মোটরসাইকেল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ৪০ মিনিটের রাস্তা যেতে সময় লাগছে দেড় ঘণ্টা। এবাবে রাস্তা মেরামত করে কোন লাভ হয়নি, নতুন করে নির্মাণ করা দরকার। স্থানীয় অনেকেই আশঙ্কা করেন, সামনের বর্ষা মৌসুমে ভোগান্তি বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। তার আগেই কিছু একটা করার দাবি তাদের।
কুমারখালীর চাপড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনির হাসান রিন্টু সাংবাদিক জাহিদুজ্জামানকে বলেন, যে সংস্কার কাজ হচ্ছে তা টাকা নষ্ট ছাড়া কিছুই না। একদিক থেকে ইট বিছায়ে সারতে সারতে যাবে, ফিরে এসে দেখবে আগের মতোই হয়ে যাচ্ছে। এভাবে কাজ নয়, এই রাস্তা তুলে ফেলে নতুন করে পিচ ঢালাই দিতে হবে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুর রহমান মন্ডল সাংবাদিক জাহিদুজ্জামানকে বলেন, এলজিইডির তত্বাবধানে টেন্ডারের মাধ্যমে সড়কটি পূন:নির্মাণের জন্য কাজ পেয়েছিলেন রাফিয়া কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড এম এম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিডেট। কুমারখালীর লাহিনী-সান্দিয়ারা ১৫.৬ কিলোমিটার এবং সদরের বিত্তিপাড়া-জমজমি ১৭ কিলোমিটার সড়ক পূন:নির্মাণের জন্য তাদেরকে কার্যাদেশ দেয়া হয়। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে মোট ৩০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর তাদের কাজ শুরু করার কথা ছিলো। অল্প কিছু মাটির কাজ করেও তারা। এরপর একদিকে করোনা মহামারী শুরু হয় অন্যদিকে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দুটির একটির মালিক ব্যক্তিগত অন্য কারণে পুলিশের কাছে গ্রেফতার হলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রেক্ষিতে কুষ্টিয়া এলজিইডি ২০২০ সালের শেষের দিকে কার্যাদেশ বাতিল করে নতুন টেন্ডারের অনুমোদন চেয়ে এডিবিকে চিঠি দিয়েছে। একই সঙ্গে কার্যাদেশের অর্থ ফেরত নিতে (নগদায়ন) ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিলে তারা ঢাকা জজ কোর্টে আরবিটিশন মামলা করেছেন। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মামলায় বলা হয়েছে- নির্মাণ কাজের মেয়াদ ৩১ মে ২০২১ এখনো শেষ হয়নি, তাই কাজ বাতিল বা অর্থ নগদায়ন করতে পারবেন না কর্তৃপক্ষ। তবে, কুষ্টিয়া এলজিইডির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মামলা কোন ইস্যু না, সেটি তার গতিতেই চলবে।
এডিবি থেকে অনুমতি পাওয়া গেলেই আবার নতুন টেন্ডারের মাধমে কাজ শুরু করা যাবে। এরমধ্যে মানুষের ভোগান্তি বিবেচনায় ভ্রাম্যমাণ রক্ষণাবেক্ষণ ফান্ড থেকে বড় বড় গর্তগুলো মেরামতের কাজ করা হচ্ছে সাংবাদিক জাহিদুজ্জামানকে বলেন প্রকৌশলী জাহিদুর রহমান মন্ডল। নতুন টেন্ডার না করা পর্যন্ত এর বাইরে তাদের কিছু করা সম্ভব না।
Leave a Reply